গত কালই ছোট্ট হিয়া কে নিয়ে নার্সিং হোম থেকে ফিরেছে দিয়া। সময়ের আগেই দিয়ার ডেলিভারি করাতে হয়। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, দিয়ার কন্ডিশন তেমন ভালো না। এক্ষুনি সিজার করে বাচ্চাকে বের করে না আনা হলে মা ও শিশু দুজনেরই ক্ষতি হতে পারে। আর আট মাস হয়ে গেছে। এখন বাচ্চা মায়ের শরীরের থেকে বাইরেই ভালো থাকবে। তাই আর কোনো ঝুঁকি না নিয়ে ডাক্তারবাবুর পরামর্শমতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাচ্চাকে নিয়ে বাড়ি আসার আগেই বাড়ি সেজে উঠেছে একেবারে নতুনভাবে। এসে গেছে বেবি কট, জানলায় নেট লাগানো হয়েছে যাতে মশা, মাছি ঢুকতে না পারে। পুরো বাড়িতে আনন্দের পরিবেশ। বাচ্চার দাদু, ঠাকুমা, দিদিমা, পিসি, কাকা, মাসি, মামা এমনকি পাড়াপ্রতিবেশিরাও খুব খুশি। কিন্তু একজনের মধ্যে যেন সেই আনন্দের অভাব। সে হল নবজাতকের বাবা। শোভন। যদিও তাঁর ডিউটিতে কোনো ঘাটতি রাখে নি। নিয়মিত ডাক্তারি চেক আপে নিয়ে যাওয়া, ওষুধপত্র কেনা বা দিয়ার মন ভালো রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু মনের মধ্যে যে অশান্তির মেঘ তা কিছুতেই কাটছিল না।
রাত তখন আড়াইটে হবে। একটু আগেই বাচ্চাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে দিয়া। নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চার কান্নায় তখনই ঘুম ভেঙে গেছে শোভনেরও। যদিও ঘাপটি মেরে শুয়েই ছিল। তাঁর আর ঘুম আসছে না। এই কদিন নার্সিংহোমে দুবেলা গেলেও একটা বারের জন্য বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার কথা ভাবে নি। আসলে বাচ্চাটাকে এখনও নিজের বলে মানতেই পারছিল না। মনে পড়ে যাচ্ছে, সেদিনের কথা। যেদিন দিয়া ও শোভনের সব রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, শোভনের সিমেনে উপযুক্ত পরিমাণে স্পার্ম না থাকায় তাঁর পক্ষে সন্তানের বাবা হওয়া অসম্ভব। শুনে তাঁর আঁতকে ওঠার জোগার। এত বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছে চাইলেই বাবা হওয়া যায়। বিয়ের পরপরই সন্তান যাতে না আসে সেজন্য কত সাবধান ছিল সে। আর এখন ডাক্তারবাবু কিনা বলে, সে বাবা হতে অক্ষম। তাঁর মেল ইগো দারুণভাবে আঘাত পায়। কোনোরকমে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়েই এক বন্ধুকে ফোন করে। সেই বন্ধু মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। তাঁর কাছে জানতে চায়, কলকাতার নামী ইনফার্টিলিটি স্পেশালিষ্টের ফোন নম্বর। বন্ধুর দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে পরদিনই সেখানে যান। আগের রিপোর্টের কথা ঘুণাক্ষরেও ডাক্তারবাবুকে জানায় না। ফলে আবার এক গাদা টেস্ট করাতে হয়। কিন্তু সেই ডাক্তারবাবুও একই কথা বলেন। তিনি পরামর্শ দেন, তারা চাইলে ডোনারের থেকে স্পার্ম নিয়ে আই ভি এফ করে এগোতে পারেন। বেশ কয়েক দিন লাগে বিষয়টা মন থেকে মেনে নিতে। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। বলা যায়, দিয়ার মুখ চেয়েই তাতে সায় দেয়। তবে মন থেকে কিছুতেই মানতে পারে না। রেজাল্ট পজিটিভ জানার পরেও মন থেকে নেগেটিভ ভাবনাগুলোকে সরাতে পারে না। কখনও কখনও মনে হত যদি এমনিতেই আবরসন হয়ে যায়! যদিও বাইরে দেখাতো, সে খুব খুশি। যেদিন ডাক্তারবাবু দিয়ার পেটে বাচ্চার হার্টবিট এসেছে দেখালেন, সেদিন দিয়া কী খুশি! বাড়ি এসে সবাইকে ফোন করে সেকথা জানায়। শোভন ল্যাপটপে কাজ করতে করতে সে সব কথা শোনে আর মনে মনে বলে, আদিখ্যেতা! নিজেকে বোঝায় সেও তো সন্তান চেয়েছিল, কাজেই এভাবে হলে ক্ষতি কথায়? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়, এ সন্তান তো তাঁর নয়। তাকে মেনে নেবে কী করে? ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে এসেছিল। হঠাৎ একটা কেমন আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে, মেয়ে আবার জেগে গেছে। মিহি গলায় কাঁদছে। দিয়াকে আস্তে করে ডাকলো। কিন্তু সে তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কেমন মায়া হল তাঁর। নিজেই আস্তে করে উঠে বাচ্চার কাছে গেল। দেখে, সে জুলজুল করে তাঁর দিকে তাকিয়ে। কান্না নেই। এই প্রথমবার সন্তানের মুখের দিকে ভালো করে দেখলো। মশারি সরিয়ে খুব সাবধানে কোলে নিল। সন্তানের স্পর্শে সারা শরীরে তখন কেমন একটা ভালো লাগার অনুভূতি। আগেও তো ভাগ্নে, ভাগ্নীদের এত ছোটো অবস্থায় কোলে নিয়েছে। এরকম তো লাগে নি। আরো ভালো করে বুকের কাছে নেয় তাকে। বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। এতদিন মুখ ফিরিয়ে রাখার জন্য মনে মনে ক্ষমা চায়। মনে মনে বলে, ভালো থাক মা। নিজে বুঝতে পারে শুধু মা হওয়া নয়, বাবা হওয়াও মুখের কথা নয়। আর সেদিন থেকে পুরো বাবা হওয়ার সংকল্প নেয় শোভন।
#drindranilsaha