গোলাপি আবির

গোলাপি আবির

Dr Indranil Saha

আমি মোহনবাগানি। মাঠে গিয়ে কোনোদিন মোহনবাগানের খেলা দেখিনি। মোহনবাগান জিতলে উদ্দাম আনন্দে মেতে উঠি না। ফুটবল যে আমার খুব প্রিয় খেলা তাও নয়। কিন্তু আমি মোহনবাগানি। আমাদের বাড়ির সবাইও। যখন ছোট ছিলাম রেডিওতে মোহনবাগানের খেলার ধারাভাষ্য শুনতাম “বাবুর” সঙ্গে। বাবু আমার মেজজেঠু, আমাদের ভাইদের প্রিয় বন্ধু। তারপর বাড়িতে সাদাকালো টিভি এল, সুব্রত-প্রসূন-মানস-বিদেশ নামগুলো চিনলাম। যদিও ওরা কেউই খুব একটা কাছের লোক হয়ে উঠলো না। মনপ্রাণ জুড়ে একটাই নাম সুনীল গাভাসকার। মোহনবাগান হারলে মনখারাপ হয়ে যেত। আরো খারাপ লাগতো ইস্টবেঙ্গলের কাছে হারলে। ইস্টবেঙ্গলকে হারালে ফুরফুরে ভাব। তখন টিভিতে পুরো খেলা দেখলেও পরদিন বাড়িতে আসা তিনটে বাংলা খবরের কাগজের খেলার পাতা বারবার পড়তাম। এমনকি সেদিন অংক পরীক্ষা থাকলেও। আমি এইরকম মোহনবাগানি। এখন ফুটবলের খবর বিশেষ রাখিনা। মোহনবাগান টিমের কারোর নাম জানিনা। কিন্তু যদি শুনি মোহনবাগান জিতেছে মনের মধ্যে সেই ফুরফুরে ভাব ফিরে আসে। কিন্তু এবার লিগ জেতায় সেই ব্যাপারটা ঠিক অনুভব করতে পারলাম না। কোথায় যেন তাল কেটে গেল। একটা তিতো স্বাদ জিভে লেগে রইল। শুধু একজন লোকের বেফাঁস মন্তব্যের জন্যই কি?

আমি যে এমন কথা এই প্রথম শুনলাম, তেমন নয়। এমন লোকও অনেকেই আছেন। নিজের বাড়িতে, পাড়ায়, বাজারে, বাসে, ট্রামে সব জায়গায়। আমার চেম্বারে যারা অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসেন তাঁদের কাছেও। এত প্রচার সত্ত্বেও এখনও আমাদের ক্লিনিকে Sex determination এর অনুরোধ আসে। তাঁদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত। অনেক সময় শাশুড়ি আসেন বউমাকে নিয়ে। অনেকে আবার জিজ্ঞাসা করেন আমি ব্যাংকক নিয়ে গিয়ে IVF করি কিনা। কারণটা সবার জানা। নাতি হয়েছে বলে ঠাকুরদা সোনার হার দিতে চেয়েছেন। আর নাতনি হয়েছে বলে শুনতে হয়েছে “মেয়ের বাপ আপনার ফিজটা দিয়ে দেবে”। বিয়ের ১২ বছর পর দুবার IVF ফেল করার পর কন্যা সন্তান হয়েছে দেখে বাবার মন খারাপ। তিনিই কিছুদিন আগে চেম্বারে চেক-আপে এসে দঙ্গল সিনেমা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বলছিলেন, সব বাবাদের এভাবে মেয়েদের মানুষ করা দরকার।

তিজুর জন্মের আগেই আমরা জানতাম, আমাদের মেয়ে হবে। ultrasound রিপোর্ট থেকেই জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখনই ইংল্যান্ডে অনেক হাসপাতালে ultrasound Sex determination বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেখানে এশীয় পপুলেশন বেশি। দেখা গেছিল, ultrasoundএ যত কন্যাসন্তান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যেত তত মেয়ের জন্ম হচ্ছিল না। অনেক এশীয় দম্পতি মেয়ে হবে জানতে পেরে নিজের দেশে ফিরে গিয়ে pregnancy terminate করে আসত।

তিজুকে নিয়ে যখন আমরা দেশে ফিরে আসি তখন এই সান্ত্বনা বাক্যগুলো আমাদের শুনতে হয়েছিল- চিন্তা করিস না, পরের বার ঠিক ছেলে হবে। এত শিক্ষিত বউ তবু মেয়ে হল? আজকাল ছেলে, মেয়ে সবাই সমান। এত রোজগার করে কী করবি- মেয়ের বিয়ে দিলেই তো সব দায়িত্ব শেষ। যারা বলেছিলেন তাঁরা সবই আমার কাছের লোক। হঠাৎ করেই মাঝে মধ্যে আমাদের মুখোশগুলো খুলে যায়- কখনো দুঃখে আবার কখনো আনন্দে।

আবার পুরনো কোথায় ফিরে আসি। হ্যা, আমি মোহনবাগানি। আমি সত্যি চাই মোহনবাগান আবার লিগ জিতুক। আর সেই লিগ জয়ের আনন্দে আমরা সবাই মেতে উঠবো আবির খেলায়। কিন্তু সবুজ নয়, গোলাপি আবির। সবার মুখ ভরে যাক গোলাপি আবিরে। আমরা কাউকে বলতে শুনবো, সাত ভাইয়ের জন্মের যা আনন্দ এক মিষ্টি চম্পার জন্মে আমাদের সমান আনন্দ।
#indranilivf

Leave a comment